মেঘে ঢাকা রূপকথা – একটি পরিবারিক প্রেম কথা

ইন্দ্রাণী আজ বিয়ের পিড়িতে বসবে । বাবা-মা এর পছন্দ করা ছেলে উজান এর সাথে । কিন্তু রূপকথা গল্পতে ইন্দ্রাণী ভালোবাসে রাহুলকে । অনেক চেষ্টা করেও সে বাবা-মা কে বলতে পারেনি । এমন ভাবে সবকিছু ঠিক হয়ে যায় যে , বাবা-মা কে বুঝিয়ে বলার সময়টুকু ও সে পায়না । ইন্দ্রাণী ভেবেছিল বাবা-মা তার মনের কথা জানতে চাইবে । কিন্তু তারাও যে নিরুপায় তা ইন্দ্রাণী বুঝতে পেরেছিল । তার বাবা-মায়ের আগের ঘটনা ইন্দ্রাণী কিছুটা জানতো তাই নিজের বুকে পাথর রেখে বাবা-মা কে খুশি করতে চেয়েছিলো ।

ইন্দ্রাণী রাহুলকে শুধু এটুকুই লিখতে পেরেছিল – “ আমার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি , আমার আশার আলো আমি নিভিয়ে দিয়েছি , আমার লেখা কবিতা আমি ছিঁড়ে ফেলেছি ,আমার ভালোবাসা আমি বিলিয়ে দিয়েছি , তাই যদি পারো ক্ষমা কোরো , পরের জন্মে আমাকে তোমার কোরো ,” রাহুল সরল মনের সাদাসিদে ছেলে হলেও তার এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হয়নি , তাই সে আর ইন্দ্রানীর সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি ।

ইন্দ্রানীর বাবা রমানাথ মণ্ডল , আর মা ইশানী মণ্ডল ( সরকার ) যাতে নিজেদের জিবনের পুরানো কথা ভুলতে পারে তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে যাতে মেয়ের বিয়ের কোনো ত্রুটি না হয় । রমানাথ ও ইশানীর ভালোবাসার একমাত্র ফুল ইন্দ্রাণী । কিন্তু তারা ইন্দ্রাণী কে শহরের বড় ইংলিশ মিডিয়াম বোডিং এ রেখে মানুষ করেছে । আজ ইন্দ্রাণী উনিশ বছরের সাবালিকা । ইন্দ্রাণী শহরে থেকে বড় হলেও গ্রামের এই বাবা-মায়ের স্বভাব থেকে একটুও ব্যাতিক্রম হয়নি । ইন্দ্রাণী বাবা-মাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল , বলেছিল – “আমার শরীরে তোমাদেরই রক্ত বইছে , তাই তোমরা যেভাবে আমায় হাসি মুখে দেখতে চাও আমিও চাই তোমাদের ফিরে পাওয়া হাসি মুখ মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে । “ ইন্দ্রাণীর চোখে জল চলে আসে । বাবা-মা বুঝতে পারেনা । ইন্দ্রানীও চায়না বাবা-মায়ের শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল ফিরিয়ে আনতে । তাই বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাস মেনে নিয়ে এগিয়ে চলে । “ গায়ে হলুদের সময় হয়ে গেছে চলো ইন্দ্রাণী “ – মা বলেন । ইন্দ্রাণী মাকে জরিয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে ।

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর দায়িত্বে দিয়েও রমানাথ হাফিয়ে উঠছে সবদিক দেখতে গিয়ে । তবু তার মনে আনন্দ যে সব তার মনের মতন ও ঠিকঠাক সময়ে হচ্ছে । কার্ড ছাপা থেকে শুরু করে আত্মিয় স্বজন , বন্ধু বান্ধব সকলকে নিমন্ত্রণ করার কোনো ত্রুটি সে রাখেনি । আক্ষেপ তার মনে রয়েই গেলো সে তার নিজের বাবা-মা ও ইশানীর বাবা-মা কে বলতে পারেনি । তাদের কেউই আজ ও ইন্দ্রাণীকে দেখেনি । ইন্দ্রাণী ও জানেনা তার দাদু-দিদা আছে কিনা । ইন্দ্রাণী দু-একবার চেষ্টা ও করেছিল জানতে , কিন্তু বাবা-মায়ের মুখ দেখে কিছুটা ইঙ্গিত করতে পেরেছিল তাই আর কথা এগিয়ে নিয়ে যায়নি । রমানাথ – ইশানি ও কখনো কারো অভাব বুঝতে দেয়নি ।

রাহুলের কোম্পানি  ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর দায়িত্বে ছিল সেটা না রাহুল বুঝতে পেরেছে না ইন্দ্রাণী জানতো । বিধির বিধান তাদেরকে একজায়গায় টেনে এনেছে । রমানাথ ইন্টারনেট এর মাধ্যমে এই কোম্পানির কথা জানতে পারে এবং যোগাযোগ করে । রাহুল বিয়ের কার্ড ও বিভিন্ন ডিজাইনে ইন্দ্রাণীর নাম দেখেছিল কিন্তু সে কখনোই ভাবেনি –এই তার ভালোবাসার ইন্দ্রাণী । উজান weds ইন্দ্রাণীর ডিজাইন করতে করতে সে রাহুল weds ইন্দ্রাণীর একটা ডিজাইন করে রেখেছিল । কিন্তু তারপরেই ইন্দ্রাণীর চিঠি সবকিছু তছনছ করে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল । রাহুলের ইচ্ছা ছিল এই ইন্দ্রাণীকে একবার দেখার তাই অনেক কষ্ট বূকে নিয়ে ও রমানাথ মণ্ডলের মেয়ের কাজে সে নিজে ছুটে আসে । সারা বাড়ি  , বিয়ের গেট , বরের বসার জায়গা সবকিছুতেই রাহুল নিজের বিয়ের ছাপ ফুটিয়ে তোলে । রমানাথ খূব খুশি , কিন্তু রাহুলের মনে পাহাড় ভেঙে পড়ছে টবূ সে ইন্দ্রাণীকে একবার না দেখে যেতে পারছে না ।

পার হতে হতে ঘড়িতে আটটা , বিয়ের লগ্ন কাছে চলে আসে । হঠাৎ ই বর এসেছে বর এসেছে শব্দে ভরে যায় । ইন্দ্রাণীকে সাজানো হয়ে গেছে । পাশে থাকা বন্ধুরা ছুটে বেরিয়ে যায় বর দেখতে । ইন্দ্রাণী একা ঘরে , বুক ফেটে যাচ্ছে , বিয়ের সানাই তার কানে পাহাড় থেকে ছিটকে পড়া জলপ্রপাত মনে হতে থাকে ।চোখের জল আর আটকাতে পারে না ।মেকাপ নষ্ট হয়ে যায় । ভারি হয়ে যাওয়া পায়ে ভর দিয়ে জানালার কাছে আসে । তাকিয়ে দেখে জানালার বাইরে  , মনে মনে ভাবে – “ রাহুল তুমি কি পারলে না আমাকে এসে নিয়ে যেতে । রাহুলের কি দোষ আমিই পারিনি কাউকে কিছু জানাতে “। বিধির বিধান কে খণ্ডাতে পারে । দুর থেকে রাহুলের ও চোখ পরে ঐ জানালার দিকে । দেখতে পায় ইন্দ্রাণীকে । ইন্দ্রাণী ও দেখতে পায় রাহুলকে । রাহুলের মাথায় ব্জ্রাঘাত পরে “ এ তো আমার ইন্দ্রাণী । এতবড়ো ছল ও আমার সাথে করতে পারলো ।“ মনে মনে ভাবতে ভাবতে কিছুটা রাগ হলেও ইন্দ্রাণীর চোখ থেকে ঝড়ে পড়া জল তাকে বুঝিয়ে দিলো ইন্দ্রাণী তাকে ডাকছে ।

আস্তে আস্তে রাহুল এগিয়ে যায় ইন্দ্রাণীর জানালার দিকে । ইন্দ্রাণী মাথা নিচু করে দারিয়ে থাকে , কোনো কিছু বলার মুখ ইন্দ্রাণীর নেই । চোখের জল মুছিয়ে রাহুল বলল – “ এই যদি তোমার ইচ্ছা ছিল তাহলে কথা দিয়েছিলে কেনো । কেনো শিখিয়েছিলে ভালবাসতে । কেনো দেখিয়েছিলে এই রাস্তা । “ (রাহুলের এই ব্যাবসার আইডিয়া ছিল ইন্দ্রাণীর দেওয়া ) আজ রাহুল এক বড় কোম্পানির মালিক , আর তাকে বড় করার পিছনে জার হাত সেই ইন্দ্রাণী ই সঙ্গ ছেরে মুখ লোকাল –বলতে বলতে রাহুল কান্নায় ভেঙে পড়লো । ইন্দ্রাণী নিজেকে শক্ত করে বলল রাহুল ঘ্রের পিছনের দিকে চলো তোমাকে স্ব বলছি এখানে এক্ষুনি কেউ এসে পড়বে । ইন্দ্রাণী রাহুলকে সব কথা বলার পর দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে , এবং দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করে । এদিকে রমানাথ ছুটে আসে মেয়েকে রেখে সবাই বরের কাছে চলে যাওয়াতে , ইশানী ও ব্যাস্ত বরন করার দিকে । কিন্তু রমা নাথ মেয়েকে ঘরে দেখতে না পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে । ছুটে যায় তার স্ত্রী ইশানীর কাছে । দুজনে এসে ঘরে দেখতে পায়না মৃদু কান্নার আওয়াজ তাদের কানে ভেসে আসে । তারপর দুজনেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে রাহুল ও ইন্দ্রাণী দুজনে দুজনকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে । রমানাথ ও ইশানীর পুরানো কথা মনে পড়ে ।

রামানাথ ও ইশানী তাদের কাছে যায় ও ইন্দ্রাণী কে জিজ্ঞাসা করে তুমি কেনো আগে বলোনি এসব কথা । ইন্দ্রাণী মাথা নিচু করে থাকে । রাহুল বলে ও আপনাদের কষ্ট দিতে চাইনি । ও চাইনি আপনাদেরকে হারাতে । রমানাথ ও ইশানী জরিয়ে ধরে ইন্দ্রাণী কে । কেন মা ? কেন ? তোর কথা বললে কি আমরা মেনে নিতাম না । ইন্দ্রাণী বলল – “ আমি জানিনা আমার দাদু দিদা কে ?, তোমাদের আগের ঘটনা , আমি কোনো কিছু জানতেও চাইনি তোমাদের কাছে , পাছে তোমরা কষ্ট পাও , আমি জানি মা পরিবার ছেড়ে কেউ খুশি থাকতে পারেনা ”।  আমরাও নেই । কিন্তু তা বলে তোরা খুশি আনন্দ আমাদের জন্য বিসর্জন দিতে পারিস না । আমাদের ভুল হয়েছে তোর জানার অধিকার আছে। আজ তোকে সব বলবো । ইশানীর চোখে জল ।

অন্যদিক

তার মায়ের বাবা মস্ত বড় জমিদার দেবকুমার সরকার । নিজের মেয়ে ইশানীকে নিজের প্রানের থেকেও বেশী ভালবাসতেন । আদরের মেয়ে ইশানীকে যাতে ছোটবেলাতেই অনেক দূরে পড়তে যেতে না হয় তাই গ্রামের জমিদার বাড়ির কাছেই স্কুল তৈরি করেন ।  আমার (রমানাথের) বাবা আদিনাথ মণ্ডল ছিলেন সরকার মশাই এর নায়েব । নিচু জাত হলেও আমাদের পরিবার বংশ পরম্পরায় জমিদার বাড়িতে চাকরি করে আসছে । সরকার মশাই নিজের স্ত্রী ও মেয়ের পর আমার বাবা আদিনাথকেই বেশী বিশ্বাস করতেন…………………।

রঘুনাথপুর গ্রামের জমিদার দেবকুমার সরকার । গ্রামের মানুষ ভগবান বলে মানেন । অন্যায় করলে উনি যেমন কঠোর শাস্তি দেন তেমন ই ভালো কাজ করলে পুরস্কার ও দিতে ভোলেনা । রমানাথকে নিয়ে বাবা আদিনাথ ও মা মীরা জমিদার বাড়ীতেই থাকতেন । সরকার মশাই এর কথাতেই রমানাথকে এই স্কুল এ ভর্তি করা হয় যেখানে ইশানী পড়েন । আদিনাথ স্কুলে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার কাজটা করতেন  ইশানী ও রমানাথকে একসঙ্গে । ইশানী ও রমানাথের একই সঙ্গে খাওয়া দাওয়া ও খেলাধুলা চলতে থাকে । আস্তে আস্তে দুজনে ক্রমশ বড় হয় । ইশানী চলে যায় শহরে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি পড়ার জন্য , রমানাথ পাশের গ্রামের কলেজে গ্র্যাজুযেশন । দেবকুমার সরকার এর ইচ্ছা ইশানী গ্রামের বড় ডাক্তার হোক ।গ্রামে ভালো ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব । একবার সামান্য ঝড় থেকে ডাক্তার ও ঔষধ এর অভাবে মৃত্যু হয়েছিল বেশ কিছু প্রজার । পাঁচ বছর পর প্র্যাকটিস শেষ করে , বাবার তৈরি করে রাখা হসপিটালে ডাক্তারি করতে থাকে ইশানী । রমানাথ গ্রাজুয়েশন শেষ করে ছোটবেলার পাড়ার  স্কুলে হেডটিচার হিসাবে কাজ করতে থাকে । রমানাথ ও ইশানীর মধ্যে দেখা হলেও গভির টান আর ছিল না ।

একদিন রমানাথ স্কুলের থেকে ফেরার পথে গেটের কাছে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে আসে । কিন্তু বাচ্চাটাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাননা । রমানাথ বাচ্চাটিকে ফেলে যেতে পারে  না । কোলে তুলে নেয় তাকে । বাচ্চাটার গা গরমে পুড়ে যাচ্ছে তাই দেরি না করে ইশানীর হসপিটালে নিয়ে যায় । ইশানী সব রকম চিকিৎসা করেও বচ্চাটার জ্বর কমাতে পারেনা । রমানাথের মুখে সব কিছু শোনার পর বলে – বাচ্চাটার এখন একমাত্র চিকিৎসা টার মায়ের গরম শরীরের ছোঁয়া । রমানাথ ও ইশানী ভেবে পায় না কি করবে । রমানাথ ইশানী কে বলে তুমি ই ওর মা হও  এছারা কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না । অনেক কথা কাটাকাটির পর অবশেষে ইশানী রাজি হয় । ইশানী বাচ্চাটিকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে যায় ও সারা রাত তাকেই নিয়ে থাকে আর রমানাথ বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে ।

সকালে বাচ্চাটির জ্বর কমলেও ইশানী ছেড়ে দিলে কাঁদতে থাকে ফলে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়েই ডাক্তারি করতে হয় । এবং রমানাথ ও তাকে হেল্প করতে থাকে । ইশানীর বেশ কয়েকদিন বাড়িতে ফেরা হয় না । এদিকে রমানাথ ও ইশানীর কথা বাচ্চাটিকে নিয়ে অন্যরকম ভাবে ছড়িয়ে যায় । তারাও কাউকে সত্যি বলতে পারে না । জমিদার দেবকুমার ও তাদের সম্পর্ককে অন্যভাবে নিয়ে , অনেক কথা কাটাকাটির পর তাদেরকে পানিশ করে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন । এরপর সকলকে ছেড়ে তারা চলে আসে , অন্য গ্রামে একটি মন্দিরে এসে তারা বিয়ে করে । একটি বাড়ি ভারা নিয়ে রমানাথ ও ইশানী –পড়ানো ও ডাক্তারি করতে থাকে , কোনো দাবি তাদের থাকে না । যে যা টাকা দিত তাই নিত । এই ভাবে বাচ্চাটিকে কেন্দ্র করে তাদের সংসার চলতে থাকে । তারা এই বাচ্চাটির নাম রেখেছিল ইন্দ্রাণী ।

আগে ফিরে আসা

ইন্দ্রাণী জরিয়ে ধরে বাবা-মাকে । শেষ পর্যন্ত রাহুলের সঙ্গে ইন্দ্রাণীর বিবাহ সু-সম্পন্ন হয় । 

কলমে – অমিত পাল ।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাধা আয়েঙ্গার প্লাম্ব –আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x