অনলাইন ফ্রেন্ডস – কলেজে ভর্তির ফর্ম জমা দিয়ে এসে ওয়াই-ফাই সিটি তে ব্যাস্ত অরিন্দম , সঞ্জয় , ঋতিকা , রতন ও বর্ণালী । ১২-১৩ ঘণ্টা কাটানো স্কুল – কলেজের স্টুডেন্টদের এই পাঁচ বন্ধু ও আজ ওয়াই-ফাই সিটি র ব্যাস্ত মেম্বার । ওয়েস্ট বেঙ্গল এর নাম করা এই ওয়াইফাই পাড়া । মনের মত গেম ডাউনলোড , ফেসবুক , হোয়াটস্ অ্যাপ , টুইটার ছাড়াও অনলাইনে নিজের নিজের পছন্দমত সাইটে ঢূকে জেণে নেওয়ার তাগিতে ছুটে আসে অনেকেই ।
ছড়িয়ে ছীটীয়ে থাকা অ্যাক্সেসের যত কাছাকাছি থাকা যাবে ততই ভালো ওয়াইফাই কানেকশন পাওয়া যাবে আর ডিসটেন্স বেশী হলে দেখাবে অ্যাকসেস ডিনায়েড বা জিও নেট নট ইন রেঞ্জ । আরিন্দম , সঞ্জয় , ঋতিকা , রতন ও বর্ণালী প্রথম আসলেও জায়গা চিনে নিতে তাদের ভুল হয়নি দেশের প্রথম ওয়াইফাই নগরীকে ।
অরিন্দম মিত্র , বাবা গৌতম মিত্র , মা সঞ্চারী মিত্রের একমাত্র সন্তান । দিনরাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে কাটালেও পড়ার সময়টুকু সে ঠিকঠাক পড়ে । স্কুলের ফাস্ট বয় হওয়ার সুবাদে তাকে অনেকেই চেনে ।
বাবা কুন্তল বক্সি , মা অঞ্জনা বক্সির ছোট ছেলে সঞ্জয় পড়াশোনায় ভালোই । ইদানিং বাড়িতে কম সময় দেওয়ায় / থাকায় বাবা-মা একটু অসন্তুষ্ট ।
কাউন্সেলর নাগরাজ রায় ও ইশিকা রায় এর মেয়ে ঋতিকা রায় । ছেলে বন্ধুদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে আড্ডা দিতে তার ভালোলাগে । রুটিং মাফিক পড়া ছাড়াও শরীর চর্চা তার অভ্যাস ।
বৌবাজারে কর্মরত কারিগর ধ্রমেন্দ্র কর্মকার ও সীতা দেবীর একমাত্র ছেলে রতন । এতদিনেও তাকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিতে না পাড়ার জন্য বাড়িতে কথা কাটাকাটি লেগেই আছে ।
বর্ণালী বসু , বাবা ইন্দ্রনাথ বসু , মা শ্রাবণী বসু , পড়াশুনোয় খুব ভালো না হলেও তার ইচ্ছা সে একজন নামকরা অভিনেত্রি হবে । বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে লাইক পাওয়া তার প্রথম পছন্দের কাজ ।
একপায়ে দাড়িয়ে থাকা মাছ খেকো বকের মতো , বিভিন্ন পোজে দাড়িয়ে থাকা সকলের চোখ শুধু স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে । অনেক ভিড় থাকলেও ওয়াই-ফাই সিটি র ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে যেখানে কানেকশনের তেজ সবথেকে বেশী সেই যায়গাটা বেশ নিস্তব্ধ । অরিন্দম , সঞ্জয় , ঋতিকা ,রতন , ও বর্ণালী এরা কেউ ফেসবুক , কেউ হোয়াটস্ অ্যাপ অথবা গেমস , অ্যাপ ডাউনলডে ব্যাস্ত । রতনের মন একটু খারাপ , অন্যদের মতো নতুন দামি ফোন তার নেই । বাবা-মাকে বলার সত্বেও একটা দামি ফোন তার কপালে জোটেনি । তাই মাঝে মধ্যেই অন্যদের ফোনে উকি দিতে হচ্ছে তাকে ।
ঋতিকা আর বর্ণালীর মধ্যে হচ্ছে কম্পিটিশন কে কটা লাইক পেয়েছে ফেসবুকে ,ফেসবুক স্ট্যাটাসে দুর্দান্ত পোজ দিয়ে ছবি তুলে আপলোড করতেই পাঁচ মিনিটে ৩৪ টা লাইক পেল ঋতিকা । বর্ণালী ও কম যায় না সাত মিনিটে লাইক ৪০ পার করে দিলো । সঞ্জয় বলে উঠল তোরাই ভালো আছিস রে আমার পনেরো মিনিট হয়ে গেল একটাও কেউ লাইক করল না। অরিন্দম বলল আচ্ছা ঠিক আছে আমি একটা লাইক দিলাম নে । রতন বলল ছবিতা র জেন্ডারটা চেঞ্জ করনা দেখবি কতো লাইক পাবি ।
বিকেল পাঁচটা …
আমারও পরাণও যাহা চায় – বেজে উঠল সঞ্জয়ের ফোনে । এই দাড়া মায়ের ফোন এসেছে , মা বললেন –“ বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে তোমাদের কলেজের কাজ কি এখনও শেষ হয়নি ? “এভাবে সকলের বাড়ি থেকে ফোন এলেও রতনের বাড়ি থেকে আসা ফোন রিসিভ করে না । তারপর সকলে বাড়ি ফেরে সকলের বাড়ীতেই টুকিটাকি কথা কাটাকাটি হয় ফেরার পর ।
তিনদিন পর কলেজে –
একসাথে দেখা হলেও সকলের একসাথে একই কলেজে থাকাটা কপালে জুটল না । অরিন্দম ও ঋতিকা একই কলেজে চান্স পায় । সঞ্জয় ও বর্ণালী আলাদা কলেজে কিন্তু রতনের ভাগ্যে কোনো কলেজ জোটে না । হন্যে হয়ে ঘোরার পর রতন অবশেষে একটা গ্যারেজে কাজে লাগে ।
প্রত্যেকেই হাত খরচের টাকা থেকে মবাইলের নেট খরচের টাকা রিচার্জ করে । ডিনারের শেষে ফেসবুক অন করে অরিন্দম । প্রথম দিনের কলেজের ছবি পোষ্ট করে সঙ্গে ঋতিকার ছবিও ছিল । সঞ্জয় , ঋতিকা বর্ণালী ও রতন লাইক করে । শুরু হয় পঞ্চ বন্ধুর চ্যাটিং । কিছুক্ষন পড়ে অরিন্দমের পোষ্টে লাইক আসে অনিতার । কে এই অনিতা ? প্রশ্ন সকলের । কোনো ছবি ও ডিটেলস্ নেই অ্যাকাউন্টে । অরিন্দম ও অনিতা একই কলেজের প্রথম বর্ষ এর স্টুডেন্ট অনিতা জানলেও অরিন্দম কিছুই জানেনা । অনিতা অরিন্দমের সব কিছুতেই লাইক করে , কমেন্টস্ দেয় । কারন অনিতা মনে মনে অরিন্দমকে ভালোবাসে কিন্তু তা বলতে পারেনা ।
বেশীরভাগ সময় ঋতিকার সাথে একসাথে থাকে বলে, তাকেই অরিন্দমের গার্লফ্রেন্ড ভাবে তাই সাহস করে এগোয় না । এই ভাবে ফেসবুক , হোয়াটস্ অ্যাপ এর মাধ্যমে নিজের মনের কথা বোঝানোর চেষ্টা করে । অনিতা কলেজে অনেকের থেকেই প্রপোজ পায় কিন্তু একসেপ্ট করেনা । কলেজের নবিন বরন অনুষ্ঠানে গানের পারফর্ম করে অনিতা , ঋতিকা ছাড়াও অন্যান্যরা । অনিতার গানে অরিন্দম অন্য কিছু খুজে পায় । অনিতার ছবি ফেসবুকে আপলোড করে । ঋতিকা বন্ধুদের মধ্যে অনিতার অনুপ্রবেশ নিয়ে সঙ্কোচ প্রকাশ করে । বন্ধুত্বের মধ্যে ভাঙন ধরে ।
অনিতা পড়ে জানতে পাড়ে ঋতিকার সাথে অরিন্দমের সম্পর্কের কথা ও বন্ধু দের সম্পর্ক ভাঙার কথা । অনিতা চেষ্টা করতে থাকে কি ভাবে এদের সম্পর্ক ঠিক করা যায় । অনিতা অনলাইন ফ্রেন্ডস গ্রুপ নামে একটি আলাদা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলে । এখানে অনিতার পুরো ডিটেলস থাকে না । অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে অরিন্দম , ঋতিকা , সঞ্জয় , বর্ণালী ও রতনকে রিকোয়েস্ট পাঠায় এবং একসেপ্ট হয় । সকলের মধ্যে দূরত্ব বাড়ায় অনলাইন ইন্টারনেটের প্রতি আকর্ষণ বারে । নিজ নিজ ফ্যামিলির বাবা-মা এর সাথে সম্পর্কের অবন্তি হতে থাকে । এর ফলে সকলের একমাত্র বন্ধু হয়ে ওঠে মোবাইল , কম্পিউটার সাথে নেট কানেকশন ।
রতনের সাথে গ্যারেজে কাজ করত দশ বছরের একটি ছেলে মুন্নু । রতন অনেকবার বলেছিল মুন্নুকে তুই এত ছোট বয়সে পড়াশুনো না করে কাজ করছিস কেনো ? কাজ ছেড়ে দে হাত খরচা লাগলে আমার থেকে নিস । মুন্নু বলেছিল না দাদা আমার বাবা – মা দুজনেই হ্যান্ডিক্যপড আমি কাজ করে টাকা না নিয়ে গেলে সংসার চলবে না । আর আমার মায়ের চোখ দুটো ঠিক করতে হবে আর তার জন্য অনেক টাকার দরকার । রতন বলল আচ্ছা ঠিক আছে আমিও তোকে কিছু হেল্প করব । মুন্নু বলে দাদা তোমার অবস্থাও তো খুব ভালো না । ঠিক আছে এখন কাজ কর বলে দুজনে কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে ।
রতন মুন্নুকে নিয়ে অরিন্দমের কাছে যায় , অরিন্দমকে তার কলেজ ও বন্ধুদের মাধ্যমে কিছু সাহায্যের কথা বলে । অরিন্দম অনেককে বললেও খুব বেশী সাহায্য পায়না । অরিন্দমের মাথায় আসে ফেসবুকের কথা , মুন্নুর ছবি সহ অ্যাড দেয় তাকে হেল্প করার জন্য এবং সকলকে শেয়ার করার কথা বলে অনলাইন ফ্রেন্ডস গ্রুপ এর মাধ্যমে কয়েকদিনের মধ্যে অনেক ফান্ড কালেকশন হয় ও তার সাথে শুভেচ্ছা । মায়ের চোখ অপারেশনের পড়ে বাবার চিকিৎসা হয় । বাবা-মা দুজনেই খুব খুশি হয় মুন্নু কে জরিয়ে ধরে । মুন্নুর হঠাত মাথা ঘুরে যায় , চেকআপ এরপরে মুন্নুর ক্যান্সার ধরা পড়ে । কোনোকিছু করার আগেই কয়েকদিনের মধ্যে মুন্নু মারা যায় । মেসেজ ফুটে ওঠে ফেসবুকে , সবাই অবাক হয়ে যায় । এই কদিনে মুন্নু খুব ফেমাস হয়ে উঠেছিল । তাই অন্যান্য বন্ধুরা ছাড়াও অতিন্দম , অনিতা , ঋতিকা ,সঞ্জয় , বর্ণালী , রতন সকলেই আসে । তারা ভেঙে পড়ে মুন্নুকে হারানোয় । মুন্নুর জন্য বন্ধুরা ফিরে পায় তাদের বন্ধুত্ব।
মুন্নুর বাবা-মা কে দেখার ভার নেয় সকলে মিলে ।
সকলে মিলে মিটিং করে । যাতে মুন্নুর মতো অবস্থা আর কোনো বাচ্ছার না হয় । তৈরি করে এক নতুন NGO, The online friends group. কাজ হয় বাচ্ছাদের পড়াশুনো , চিকিৎসা ও দায়িত্ব নেওয়া । মুন্নুদের বাড়ি টা এই কাজের জন্য ব্যাবহার করা হয় । ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশ বিদেশে বড়ো ব্যাক্তি ও কোম্পানি গুলির সাথে যোগাযোগ করা হয় সাহায্যের জন্য । বেশ ভালো সাহায্য আসতে থাকে এবং বিভিন্ন ভাবে এই NGO র সদস্যরা সাহায্য করতে থাকে । মূল মন্ত্র হল – “ হাত ধর সাহায্য কর “ । দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সারা পাওয়া যায় এই মন্ত্রের । অরিন্দম ও অনিতা অনেক বেশী পরিচিত হতে থাকে দেশ বিদেশে ।
একদিন দুপুর বেলা হঠাৎ একটা ভিডিও আসে মেইল এ । তাতে একটি ছোট্ট বাচ্ছা বলছে – “ দিদি আমি আফ্রিকা থেকে বলছি ( আফ্রিকার একটি গরীব গ্রাম থেকে ) কোনো ভাবে একজন uncle এর সাহায্যে তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি । I need help , I don’t have money , Have a hole in my heart , please help me . অরিন্দম ও অনিতা অবাক হয়ে যায় , কি করবে ভেবে পায়না । এটা কি সত্যি নাকি খারাপ লোকদের চক্রান্ত ,মুন্নুর বাবা-মা বলল অনিতাকে –“ দিদিভাই তুমি , অরিন্দম বাবু দেখো এসে , ওকে আমাদের মুন্নুর মতো লাগছে । ঋতিকার বাবার সাহায্য নিয়ে বিদেশের টিকিট , পাসপোর্ট করা হয় । অনিতা আর অতিন্দম পাড়ি দেয় বিদেশে । অনিতা তার মনের কথাগুলি বলে অরিন্দমকে যেতে যেতে । অনিতা এবং অরিন্দমের ভালোবাসার সম্পর্ক আরও গভীর হয় । সেখানে গিয়ে সত্যতা যাচাই করে বাচ্চাটির চিকিৎসা করায় তারা । সমস্থ আপগ্রেড তারা ফেসবুকের মাধ্যমে সমস্ত বন্ধুদের কাছে পাঠিয়ে দেয় । সকলের দৃষ্টি এখন ঐ বাচ্ছাটির দিকে । বাচ্ছাটি সুস্থ হয় এবং ওরা আফ্রিকা থেকে আশীর্বাদ নিয়ে দেশে ফেরে । এরপর প্রধান মন্ত্রী The online friends group এর সদস্যদের ডেকে পাঠায় । সেখানে পুরস্কার দেওয়া হয় , বলেন প্রয়োজনে তিনিও সাহায্য করবেন । অরিন্দম , ঋতিকা , সঞ্জয় , বর্ণালী ও রতনের বাবা-মা , আত্মিয় পরিজন সকলে টিভিতে দেখে গর্ব অনুভব করেন ।
কলমে – অমিত পাল